রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৫:৩৮ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

লিমিটেড নির্বাচন আনলিমিটেড দহন

মোস্তফা কামাল:
নির্বাচন এলে একটু-আধটু বিনোদন এমনি এমনিই জোটে। জমে রঙ্গব্যঙ্গ। তা নির্বাচনটা একতরফা হোক আর বহুতরফাই হোক। ২৯৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগেভাগেই ভোটের কিছু খোরাক দিয়েছে। জাতীয় পার্টি ২৮৯ আসনের ঘোষণা দিয়ে রসদ সাপ্লাই করেছে আরও বেশি। ২৯৮ আর ২৮৯-এর মধ্যে তফাত ৯ হলেও সংখ্যা দুটি দেখতে কাছাকাছি। নাটকীয়তা তার চেয়ে ঢের বেশি। আওয়ামী লীগ এবার ডামি, স্বতন্ত্র, বিদ্রোহীর দুয়ার খুলে দিয়েছে। জাপায় এসবের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারিতে বলা হয়েছে কোথাও কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে বহিষ্কার করে দেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগ এবার জোটগত ভোট করবে না এ ঘোষণা ছিল আগে থেকেই। এর ফাঁকে আবার কিছু ছাড় রেখেছে। কিছু মানে মাত্র দুটি। একটি নারায়ণগঞ্জ-৫ মহাজোটগত প্রার্থী জাতীয় পার্টির সেলিম ওসমানের জন্য। আরেকটি ১৪ দলীয় শরিক জাসদের হাসানুল হক ইনুর জন্য কুষ্টিয়া-২। এতে ভীষণ চটেছেন ১৪ দলীয় জোটের আরেক শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তার ঢাকা-৮ আসনে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমকে। মেননের জন্য একি কষ্টের! আরও কষ্টের কারণ ক্ষমতাসীন দল থেকে কিছু তাচ্ছিল্যকর বক্তব্য। সাধারণ সম্পাদকের পর তথ্যমন্ত্রীও স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, এবার আগে থেকেই সিদ্ধান্ত ছিল জনপ্রিয়তার দৌড়ে পিছিয়ে গেছেন বা কোনো কারণে বিতর্কিত হয়েছেন তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না। সেখানে কে মন্ত্রী বা বড় নেতা সেটি বিষয় নয়, জনপ্রিয়তা যার নেই তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। পরক্ষণে আবার বলেছেন, নমিনেশন দিলেও জোটের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। আমরা ১৪ দলীয় জোটগতভাবে নির্বাচন করব। অন্যদের সঙ্গে সমন্বয় করতে হলে করব।

রাশেদ খান মেনন এ ধরনের কথায় তুষ্টু হওয়ার লোক নন। নমিনেশন দিয়ে ফেলার পর এ ধরনের নরম কথার মানে তিনি বোঝেন। তার ঘোষণা ছিল জোটগত নির্বাচনের। তাই আশাহত ক্ষোভের জানান দিতে গিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন তিনি। এর আগে দ্বিতীয় দফায় মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার ক্ষোভে একবার বলে বসেছিলেন, ‘২০১৮তে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। এর বড় সাক্ষী আমি নিজেই। গোপনে বা ক্লোজ ডোরে নয়, তিনি কথাটি বলেছিলেন বরিশালের অশি^নী কুমার টাউন হলে ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা শাখার সম্মেলনে। পরে তাকে এ জন্য ১৪ দলের কারণ দর্শানো চিঠির জবাব দিতে হয়েছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এবারের নির্বাচনটি এখন পর্যন্ত লিমিটেড। আজ্ঞাবহদের মধ্যেই তা সীমিত। কিন্তু দলীয় বা মিত্রগত এসব রঙ্গের সঙ্গে ব্যঙ্গ যোগ হচ্ছে বড় পরিসরে। এক কমিশনার বলছেন, বিএনপি এলে তফসিল পেছাতে পারে। আরেকজন বলছেন, বিএনপি বা কোনো দল আসতেই হবে নির্বাচনী বিধিতে এমন কিছু লেখা নেই। এবার ভোটাররা বলবে এমন নির্বাচন আর কখনো দেখেনি এমন আশাবাদও শুনিয়েছেন একজন। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের প্রধান নির্বাচন কমিশনাররাও শুনিয়েছিলেন এ ধরনের কথা। কেউই বেঠিক বলেননি। প্রমাণ দিয়েছেন সেই পর্যন্ত তেমন নির্বাচন আর দেখেনি মানুষ। ২০১৮ সালে জন গ্যারান্টি দিয়ে বলেছেন, এবার কেউ বিনা ভোটে জিতবে না। তিনি কথা রেখেছেন। বিনা ভোটের দরকার হয়নি। দিনের ভোট আগের রাতেই সেরে ফেলা হয়েছে। এখনকার জন নিশ্চয়তা দিয়ে বলছেন, এবার আর রাতে ভোট হবে না। এর মাঝে সোমবার নতুন কথা যোগ করে জানিয়েছেন, এবারের নির্বাচনে বিদেশি থাবা দেখছেন। কাকতালীয় বা ঘটনাচক্রে তার বক্তব্যের মিনিট চল্লিশেক পর শ্রীলঙ্কায় অবকাশ কাটিয়ে ঢাকা ফিরেছেন এখানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। বিমানবন্দর থেকে পাপ্পারাজির মতো তার পিছু নিয়েছেন সাংবাদিকরা। তারা পারেন না, এতদিন পর পিটার হাস ঢাকায় ফিরে প্রথম প্রক্ষালন কোথায় সারলেন, সেটিও জানার। এ দফায় ব্যর্থ হয়েছেন তারা।

বিদেশি থাবার কথা বলতে গিয়ে নিজের সেক্টরের বাইরে আরেকটি শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। বলেছেন, দেশের অর্থনীতি ও পোশাকশিল্পকে বাঁচাতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে। সিইসির কাছ থেকে এমন বার্তা আসা অবশ্যই লালবার্তা। এর আগের দিন রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রতিযোগিতা দূর করতে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক ও সহিংস দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে, প্রায় ১০ হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকটা আরোপের মতো তারা বলেছে, নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে ক্ষমতাসীন সরকারকে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বাক্য-শব্দগুলোর মাঝে কঠিন বার্তা নিহিত। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, ভারত, এমন কি রাশিয়ার কাছেও বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন একটি গুরুতর বিষয় হয়ে উঠেছে। টহল দেওয়ার মতো ঘুরছে তারা। বাংলাদেশ এবং এর আশপাশের অঞ্চলে তাদের দ্বন্দ্ব এখন চূড়ান্ত রূপে প্রকাশ্য। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি-পিএলএ চীন-মিয়ানমার সীমান্তে ‘প্রকৃত যুদ্ধ মহড়া’ চালিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশটিতে পণ্য পরিবহন করে নিয়ে যাওয়া একটি ট্রাক বহর আগুনে ভস্মীভূত হওয়ার একদিন পর এ বিষয়টি জানিয়েছে চীন। ঘটনাটিকে মিয়ানমারের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে বিদ্রোহীদের হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এটি এমন সময় প্রকাশ্যে এলো যখন চীন নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীনের প্রতিনিধি মিয়ানমারের রাজধানীতে শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সীমান্তে স্থিতিশীলতা আনার বিষয়ে আলোচনা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশ দুটির সম্পর্কের এ টানাপোড়েন বাংলাদেশের জন্য ভালো খবর নয়।

চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির পাঁচ বাহিনীর অন্যতম, দ্য সাউদার্ন থিয়েটার কমান্ড উইচ্যাট খুদেবার্তা অ্যাপে জানিয়েছে, এই প্রশিক্ষণের লক্ষ্য হলো ‘বাহিনীর সেনাদের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া, সীমান্ত অবরুদ্ধ করা ও সরাসরি হামলা চালানোর সক্ষমতা যাচাই করা’। এই মহড়া কখন আয়োজন হবে বা এতে কতজন সেনা অংশ নেবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়নি বিবৃতিটিতে। ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর সবচেয়ে বড় সমন্বিত, সশস্ত্র প্রতিরোধের মোকাবিলা করছে এখন। ২৪ নভেম্বর মিউস শহরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এমন সময় ঘটল যখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটির উত্তর-পূর্ব ও অন্যান্য অংশে বেশ কয়েকটি শহর ও সামরিক চৌকির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কড়া নজরদারিও চলছে সেখানে।

অশান্ত মিয়ানমারের ভাগ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ কবেই জড়িয়ে গেছে মানবতার খাতিরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র বার্মা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মিয়ানমারে যেভাবে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামে বার্মার জনগণকে সমর্থন করার কথা ঘোষণা করেছে সেভাবে বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামে সমর্থনের কথাও বলে যাচ্ছে। এর মাঝে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। সেখানে টোকা দিয়েছেন রাশিয়ার বাংলাদেশস্থ দূতাবাস। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, ‘অক্টোবরের শেষে, বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সরকারবিরোধী সমাবেশ আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে স্থানীয় বিরোধী দলের এক নেতার সঙ্গে দেখা করেন। এ ধরনের কর্ম অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্থূল হস্তক্ষেপের চেয়ে কম নয়।’

নির্বাচন নিয়ে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলছে, বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ শক্তি দিয়েই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে, বাইরের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। নির্বাচনকালে পরাশক্তিগুলোর চোখ-চশমায় বাংলাদেশ এভাবে সাবজেক্ট হয়ে যাওয়া কার জন্য সম্ভাবনার আর কার জন্য শঙ্কার হয়ে ওঠে বলা যায় না। বাংলাদেশে হাস পর্বে এখন একটি কমা বা সেমিকোলন চলছে। মোটেই ফুল স্টপ নয়। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের ‘দিল্লি আছে আমরা আছি; আমেরিকার ভারতকে দরকার; তলে তলে পিটার হাসের মুরব্বিদের সঙ্গে আপস হয়ে গেছে’ এ বার্তার পর বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা হয়েছে। আলোচনাটি দৃশ্যত এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অনুকূলে। সেই দৃষ্টে এগিয়ে চলছে নির্বাচনের যাবতীয় আয়োজন। ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমেও সম্প্রতি আবার বাংলাদেশ নিয়ে উত্তেজনাকর সংবাদের ছড়াছড়ি।

বিপরীতে মার্কিন পলিসিমেকাররা নিয়মতান্ত্রিক আশাবাদের আবাদ করে না। তারা প্রয়োগের জন্য পলিসি বানায়। তারা সরকারের কাছে এমন জিনিসই চেয়েছে, যা দিলে সরকার আর থাকে না। গণতন্ত্রায়ন আশা করে তারা। সেই সঙ্গে চায় সুষ্ঠু নির্বাচন। যা দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই। তা মালুম না করে পিটার হাস চলে গেছেন বলে একদল উল্লাসে মাতে। পিটারকে পেটানো, হাসকে জবাই করে খাওয়ার হুঙ্কারদাতা মহলের বিপরীতে আরেক দলের আশা, পিটার হাস তাদের ভগবান হবেন। পিটার হাস ঢাকা ছেড়ে গেছেন মানে চলে যাননি। তিনি অবকাশ শেষে হোস্ট কান্ট্রিতে ফিরেছেন। সিইসি তার নাম মুখে না নিলেও নির্বাচনে বিদেশি থাবা দেখার কথা জানিয়েছেন। দেশের অর্থনীতির সম্ভাব্য দুরবস্থার কথাও জানিয়েছেন। বাদ বাকিটা যার যার বুঝ ও বোধের বিষয়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

mostofa71@gmail.com

ভয়েস/আআ/দেশরূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION